এন কে মণ্ডলের নতুন উপন্যাস - সুন্দরী কন্যা (প্রথম পর্ব)
এন কে মণ্ডলের নতুন উপন্যাস - সুন্দরী কন্যা (প্রথম পর্ব)

দি আজকের নিউজ ওয়েব ডেস্কঃ বর্তমান কালের একজন তরুণ লেখক এন কে মণ্ডলের লেখনী থেকে এবার প্রকাশিত হতে চলেছে নতুন উপন্যাস ‘সুন্দরী কন্যা’ । উপন্যাসটি বেশ কয়েকটি পর্বে সমাপ্ত । আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘সুন্দরী কন্যা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হচ্ছে আমাদের সাইটে । লেখা পড়ে ভাল লাগলে আপনাদের মতামত জানতে দ্বিধা করবেন না ।

সুন্দরী কন্যা

আজিজের বাবা আজিজকে ছোট্টবেলাতেই রেখে মারা গিয়েছে ৷ দুই বিঘা সম্পত্তি ছাড়া তেমন কিছুই একটা নেই ৷ সাবালক অবস্থায় মা হারা হয়ে যায় আজিজ ৷ সে একজন সাধারণ গ্রামীণ ছেলে ৷ গ্রামের বাইরে প্রায় মাঠের ধারে দু বিঘা জমি জমি আছে ৷ সেই জমির এক কোণে ছোট্ট একটি কুটির আছে ৷ হ্যাঁ অবশ্য এটা কুটির ছাড়া আর কিছুই নয় ৷ বাঁশ খুঁটি কঞ্চি দিয়ে কুটির ৷ বাড়ির চারিপাশে নিজের জমিতে নানান শাক সব্জী ৷ বাড়ির জন্য ৷ আজিজকে শাক সব্জি কিনতে হয় না ৷ কুটির সহ কুটিরের চারিপাশে শাক সব্জীর জমি তিন কাঠা মত হবে হয়ত ৷ আর সতেরো কাঠা জমি নানান চাষ আবাদ করে ৷ ধান, গম, সরষে ইত্যাদি ৷ কুটিরের পাশেই দশ হাত জায়গায় পুকুর আছে ৷ মাছ চাষ হয় ৷ পুকুরের পাশে বিভিন্ন প্রজাতির নানান ফুলের চাষ ৷ গাঁদা, বেলি, গোলাপ, দোপাটি, চিনিফুল, ইত্যাদি ৷ বাড়ির উঠান দুর্বা ঘাসে পরিপুর্ণ ৷

বাড়ির প্রবেশ পথ একদম দুই ফিট হবে ৷ পথের দুই ধারে গাঁদা ফুলের গাছ ৷ বাড়ির টালিতে শিম ও পুঁই লতায় ছাওয়া ৷ দুই বিঘা জমি কচাগাছ দিয়ে বেড়া দেওয়া ৷ বাইরের ছাগল মুরগি গোরু প্রবেশের কোন সুজোগ নেই ৷ বাড়িটি ছবি তোলার মত ৷ মনে ধরার মত ৷ বিকেলের দিকে মনে হয় স্বর্গ ৷

কিন্তু এই স্বর্গতেই হঠাৎ নেমে এলো দু:খের ছাঁয়া ৷ হঠাৎ করে আজিজের মা স্টোক হয়ে মারা গেলেন ৷ এর আগে থেকে নানান রোগে পরিপূর্ণ ছিল ৷ রক্তচাপ বেশি হত মাঝে মাঝে ৷ তেমন একটা আয় হয় না ৷ গ্রামে তেমন একটা কাজ হয় না, তাই আজিজ রোজগার করবে ৷ পড়াশোনা তেমন একটা করতে পারেনি সে ৷ সেই গ্রামীন স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই বাবা ঈশ্বরের দেশে পাড়ি জমায় ৷ বাবার অনুপস্থিতিতেই আর পড়াশোনার সুযোগ করতে পারে নি ৷ সংসারের দায়িত্ব তাঁর ঘাড়ে এসে পড়ে , সেই ছোট্টবেলা থেকেই ৷

আজ প্রায় কুড়ি বছর হবে ৷ মায়ের মৃত্যুতে আজিজ একদম ভেঙ্গে পড়েছে ৷ তাঁর প্রধান ভরসা আর কাকে করবে ৷ কে তাঁকে খোকা বলে ডাকবে ৷ কে তাঁকে পরামর্শ দেবে ৷ সে যে একদম একা হয়ে গেল ৷ ধীরে ধীরে সংসারে হাল সবে ধরছে ৷ মায়ের মৃত্যুর আজ দুইমাস হচ্ছে ৷ নিজেকেই সবকিছু জোগাতে হচ্ছে ৷ রান্না থেকে মাঠের কাজ ৷ কিন্তু সে কি করবে ৷ তাঁর কিছুই করার নেই ৷ গরীব মানুষ ৷ দিন এনে দিন খাঁয় ৷

একদিন মাঠ থেকে এসে দুপুর গড়িয়ে রান্না করতে বসেছে ৷ চুলায় রান্না করছে ৷ দুইমাস থেকে তাঁকেই রান্না ও যাবতীয় সংসারের কাজ করতে হয় ৷ তাঁকে দুমুঠো ভাত রান্না করে দেবার কেউ নেই ৷ তাতে মাঠের এক প্রান্তে বাড়ি ৷ সেখানে তেমন একটা কেউ যায় না, মাঠের কৃষক ছাড়া ৷ আজিজ রান্না বসিয়ে, সব্জী কাটছে, এমন সময় বক্সিগঞ্জের নামকরা ঘটক রহিম সেখ গলা খ্যাকারি দিতে দিতে প্রবেশ করছে ৷

রহিম : কইরে শালা আছিস নাকি ৷ (আসলে আজিজ সম্পর্কে রহিমের চেনাশোনা দাদু হচ্ছে ৷ আর ঘটকদের রসিকতা করতে হয় ৷ তাঁদের মুখে রস না থাকলে বিয়ে টিয়ে ভালো লাগাতে পারবে কি করে ৷ গোমড়া মুখ নিয়ে কি আর ঘটকতালী হয় ৷ ঘটকতালী করে রহিম সেখ কিছু টাকা কড়ি নেই অবশ্য ৷ আর তাছাড়া বুড়ো বয়সে এই কাজ ছাড়া কি আর করবে ৷ ধর্মের কাজ করে ৷ নানান মানুষের সঙ্গে উঠাবসা করতে করতেই চলে যাচ্ছে আর কি ৷)
আজিজ : আরে দাদো যে, তা কি খবর !
রহিম : এই আসলুম, তোর কাছে ৷
আজিজ : এই নাও মাদুরখানিতেই বসো ৷ রহিম সেখ মাদুরেই ধপাস করে বসে পড়েই, ডানদিকে গাঁদা ফুলের গাছের গোড়াতেই পানের পিক ফেলল ৷ গাছের গোঁড়াটি পানের পিকে লাল হয়ে গেল ৷
রহিম : তা বলছিলুম কি যে, আর কতদিন এই হাত পুড়ে রান্না করবি ৷ বিয়ে থা কর ৷
আজিজ : দাদু তুমি কি বলো, আমার মত চাষা ছেলেকে কে বিয়ে করবে শুনি ৷ আর তাছাড়া আমার চাল চুলো কিছুই নেই, আমাকে কোন মেয়ের বাপ বিয়ে দেবে শুনি ৷
রহিম : কে দেবেনা, কে করবে না ওসব আমার উপর ছেড়ে দে ৷ আমাকে পাড়ার আকবর মোল্লা বলল, যে তোর একটা গতিবিধি করে দিই ৷
আজিজ : ওহ আকবর চাচা বলেছে ৷
রহিম : হ্যাঁ, ওর সঙ্গে গতকাল হাটে দেখা হতেই বলেছিল ৷ তা তুই বিয়ে করবি কি বল না ৷ একবার হ্যাঁ বলে দ্যাখ না ৷
আজিজ : দেখো দাদো, আমার সবকিছু দেখে শুনে কেউ যদি বিয়ে করতে চায় তবে করব, তা নাহলে করব না ৷ আর আমি তোমাকে কোন টাকা পয়সা দিতে পারব না ৷ তুমি তো আমার অবস্থা ভালোই জানো ৷
রহিম : সে তোকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না ৷ তোর বিয়ে বিনা পয়সাতেই লাগাব ৷
আজিজ : তাহলে দ্যাখো, আমার মতো মেয়ে চাই কিন্তু ৷ সাংসারিক ৷ আমি যেমন পরাণ চাষি ৷ আমার দু:খে দু:খি হতে পারে ৷ এখনকার মতো ফ্যাশন নেব না ৷
রহিম : ঠিক আছে, তোর মতোই এনে দেব ৷ ইনশাআল্লাহ ৷ তাহলে আমি উঠলুম রে ৷
আজিজ : আচ্ছা, আসো ৷

আজিজ ছেলে হিসাবে খুবই ভালো ৷ গ্রামে ভালো রিপোর্ট আছে ৷ সৎ ছেলে ৷ কোন ধরণের মিথ্যাচার, চুরি, ধান্দাবাঁজ এসব একদম পছন্দ করে না ৷ কোন স্ট্যাইল নেই ৷ ফ্যাশন নেই ৷ বর্তমানের ছেলে মেয়েদের মতো ছেঁড়া ফাটা কাটা পোষাক পরে না ৷ মোটেই গর্ব নেই ৷ কোন মেয়েদের পিছনে ঘোরে না ৷ আর এমনিতেই কোন মেয়ে তাঁর দিকে তাঁকায় না ৷ তাঁকিয়েই বা কি করবে ৷ কোন স্ট্যাইল নেই, ফ্যাশন নেই , পোষাক পরিচ্ছদ ভালো পরে না ৷ চুলে রঙ অথবা কোন স্ট্যাইলের মর্ডাণ কার্ট নেই ৷ সেই আগেকার গ্রামীন গেঁওদের মতো ঢোলা ঢোলা জামা লুঙ্গি প্যাণ্ট পরে ৷ চুল আঁচড়ানোর কোন ক্যাপাসিটি নেই ৷ একদম আনকালচার্ড পারশন ৷ বর্তমান কোন ছেলেরা এই রকম হলে, কেউ কি বিয়ে থা করবে ৷ কখনোই করতে চাইবে ৷ দরকার হলে জলে ঝাপ দিয়ে মরবে তবুও ভালো ৷ তবে মেয়েরা একদিক থেকে শ্রদ্ধা করে তাঁর ভালো মানুষকতা থেকে ৷ আজিজকে ছোট বড়ো বুড়ো সবাইকে ভালোবাসে, সবার কথা শোনে ৷ উপকার করার চেষ্টা করে ৷ কোন প্রকারের কোন অহংকার নেই তাঁর ৷ সে নিজেকে ছোট আর একা মনে করে ৷ আবার অনেক গ্রামের মানুষ আছে তাঁরা নানান উপহাস করে ৷ কয়েকজন গ্রামের অবস্থাশালী লোক আছে , তিনারা উপহাস করে ৷ দেখতে তেমন একটা পারে না ৷ বদনামও করে ৷

গ্রামের সামাজিক কর্তা ও গন্যমান্য ব্যাক্তি রফিক মল্লিক ৷ এরা পাক্কা শয়তান ৷ শয়তান জেনেও তাঁকে গ্রামের লোকেরা সন্মান করে ৷ গ্রামের যেকোন বড় পদে তাঁকেই দেয় ৷ গ্রামের রাজনৈতিক নেতাও বটে ৷ আজিজের বাবা মরার পিছনে রফিক মল্লিকেরই হাত ছিল বলে মনে করে আজিজের মা ৷ কারণ আজিজের মা জানত যে, গ্রামের ভালো মন্দ নিয়ে নানান সময় কথা কাটাকাটি হত ৷ রফিক লোকটা তেমন একটা ভালো নয় ৷ সে নিজের স্বার্থের জন্য কি না করতে পারে ৷ আজিজের বাবা আসাদুল মাঝ মাঠে খুণ হয়ে পড়েছিল ৷ কেউ তাঁকে খুণ করতে না দেখায় খুণের রহস্য খুঁজে পায় নি ৷ কয়েকবার থানায় তদন্তের জন্য ছুটে গিয়েছিল আজিজের মা, তবুও কোন কিনারা করে নি স্থানীয় পুলিশ ৷ আর কার সঙ্গেই বা লড়বে ৷ লড়েই কি পারবে ৷ টাকা পয়সার সঙ্গে পেরে উঠবে ৷ সেজন্যই জোর দেয় নি ৷ আসাদুল লোকটা ন্যায় পরায়ণ ছিল ৷ নিস্বার্থভাবে মানুষের জন্য লড়াই করতে চাইত ৷ আর তাঁরই ছেলে ছেলে আজিজ ৷